শিশুর বাতজ্বরে করণীয়
পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাতজ্বর একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা। যেখানে প্রতি লাখে প্রায় ৫০ জনের বেশি শিশু বাতজ্বরে ভোগে। টিকাদান কর্মসূচির মতো সংক্রামক ব্যাধিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু বাতজ্বর ও বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণের কোনো টিকা না থাকায় শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে বাতজ্বর আক্রান্ত ৬০-৯০ শতাংশ শিশু-কিশোরের হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
বাতজ্বর কী?
সাধারণত স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা বিশেষ জীবাণু সংক্রমণজনিত কারণে গলা ব্যথা গিরা ব্যথা, গিরা ফোলা উপসর্গ নিয়ে হাজির হয়, সেসবের সঙ্গে যদি জ্বর থাকে তাহলে সেটাই বাতজ্বর। গলা ব্যথা হওয়ার এক থেকে পাঁচ সপ্তাহ পর রোগের উপসর্গ দেখা যায়। দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনোরূপ চিকিৎসা না পেলেও অসুখ সেরে গেছে মনে হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে তা আবার দেখা দেয়। শিশু এভাবে বারবার বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে হৃৎপিণ্ডের ভালভ নষ্ট হয়ে যায়।
কারণ
গ্রুপ ‘এ’ হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার কারণে গলা ব্যথার পরবর্তী সময়ে ইমিউন প্রক্রিয়ায় হার্ট ও বিভিন্ন জয়েন্টে, কখনো বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, চামড়া বা শরীরের অন্যান্য অংশের ক্ষতিসাধন হয়। তবে গলা ব্যথা হলেই বাতজ্বর হবে—এমন ভাবাটা ঠিক নয়। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসজনিত কারণে গলা ব্যথা হয়ে থাকে।অন্যদিকে স্ট্রেপটোকক্কাসের জন্য সংঘটিত গলা কিংবা টনসিলের প্রদাহের মাত্র শতকরা ৩ ভাগ ক্ষেত্রে বাতজ্বর হয়ে থাকে। সাধারণ নিয়মে বলা যায়, যে গলা ব্যথায় নাক দিয়ে জল ঝরা ও চোখ লাল হওয়া থাকে না, তা স্ট্রেপটো ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে—এমন সন্দেহ পোষণ করতে হবে। এ ছাড়া স্ট্রেপটো গলা ব্যথায় গলার পাশের গ্ল্যান্ড বড় পাওয়া যেতে পারে, যা টিপলে ব্যথা অনুভূত হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, শিশুদের বাতজ্বরে শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে গলা ব্যথার কোনোরূপ ইতিহাস না-ও পাওয়া যেতে পারে।
কোন বয়সে কোন পরিবেশে বাতজ্বর হয়
এ রোগ সাধারণত পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের হয়ে থাকে।তবে এই বয়সসীমার বাইরে থাকা বড় অথবা ছোটদেরও এই রোগ হতে পারে। ঘিঞ্জি, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি। তবে বয়স ও পরিবেশের এই প্রভাবের বাইরে, ঠিক কোন ছেলে বা মেয়েটা বাতজ্বরে ভুগবে—তা তার জেনেটিক ধারার ওপর নির্ভর করে। আর একবার এই রোগ হলে বারবার এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুরা ছাড়াও শিক্ষক, শিশু পরিচর্যাকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এবা রোগে ভোগার ঝুঁকি বেশি।
লক্ষণ
ক. মুখ্য বা প্রধান লক্ষণগুলো
হৃদযন্ত্রের প্রদাহ (কার্ডাইটিস) : শিশুর বাতজ্বরে সবচেয়ে মারাত্মক অসুবিধা এটি, যা প্রায় শতকরা ৫০-৬০ ভাগ ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়। এর প্রধান উপসর্গগুলো হলো—শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা ও পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া। তবে কখনো বা কোনোরূপ উপসর্গ ছাড়া, অনেকটা গোপনে কার্ডাইটিসে শিশু আক্রান্ত থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ খুব সতর্ক থাকেন।
গিরায় ব্যথা ও ফুলে যাওয়া (আর্থ্রাইটিস) : শতকরা ৭০-৮০ ভাগ বাতজ্বরের শিশু এই লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। সচরাচরভাবে দুইদিকের একই প্রকারের বড় বড় অস্থিসন্ধিগুলো, যেমন—পায়ের গোড়ালি, হাঁটু, হাতের কনুুই, হাতের কবজির গিরা ফোলে।
অন্যান্য বহু শিশুরোগে গিরায় ব্যথা বা ফোলা দেখা যায়। তবে বাতজ্বরে গিরা ব্যথা ও ফোলার কিছু বিশেষত্ব আছে। যেমন—
► জয়েন্টের ব্যথা এতটা বেশি পরিমাণের থাকে যে শিশু তা স্পর্শ করতেও দিতে চায় না।
► একটা গিরায় ব্যথা কমে এলে, অন্য গিরায় ব্যথার পরিমাণ বাড়ে।
► গিরা ব্যথা ও ফোলা দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো চিকিৎসা না পেলেও নিজে থেকে সেরে যায়। কিন্তু শিশুকে এসপিরিন বা এ জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হলে ওষুধ সেবনের ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গিরা ব্যথা ও ফোলার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে, যা শিশুর বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য কখনো কখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে শিশুর গিরা ব্যথা বা গিরা ফোলা দেখা দিলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর আগে এসপিরিন ও এ জাতীয় ওষুধ শিশুকে না খাওয়ানো উচিত।
নিয়ন্ত্রণহীন অঙ্গ সঞ্চালন (খোরিয়া) : শিশুদের বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য এ লক্ষণ একাই যথেষ্ট।
চামড়ার নিচে ছোট ছোট গুটি হওয়া (সাবকিউটেনিয়াস নডিউল) : এই লক্ষণ থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে হবে যে শিশুটি বাতজ্বরের পাশাপাশি কার্ডাইটিসেও আক্রান্ত।
শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে দাগ (ইরিথেমা মার্জিনেটাম)
খ. গৌণ বা অপ্রধান লক্ষণ—
► জ্বর, সচরাচর বেশি মাত্রায় হয় না।
► শুধু গিরা ব্যথা (আর্থ্রালজিয়া) ।
► ইএসআর, সিআরপির বাড়তি মান।
► ইসিজিতে পাওয়া প্রলম্বিত পি-আর অন্তর।
► শিশু আগে বাতজ্বরে ভুগেছে এ রকম ইতিহাস।
গ. অত্যবশ্যকীয় শর্তাদি—
► স্ট্রেপটোকক্কাই কর্তৃক গলা ব্যথায় ভুগছে তার আলামতগুলো, যেমন—থ্রোট সোয়াব কালচার।
► এএসও টাইটার ও এ জাতীয় অন্যান্য এনজাইমের বাড়তি মান।
► স্কারলেট ফিভারের চিহ্নগুলো।
শিশুর বাতজ্বর রোগ নির্ণয়
কোনো একক রোগ লক্ষণ বা পরীক্ষা বাতজ্বর নির্ণয় নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কোনো শিশুকে পরীক্ষা করে যদি দুটি মুখ্য লক্ষণ বা একটি মুখ্য লক্ষণ ও কমপক্ষে দুটি গৌণ লক্ষণ পাওয়া যায় এবং সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় শর্তটি পূরণ হয়, তাহলে এই শিশু বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার জোরদার সম্ভাবনা থাকে। শিশুর বাতজ্বর নির্ণয়ের এই নিয়মকে ‘জোনস প্রণীত’ নির্দেশিকা বলা হয়। বাতজ্বর রোগ নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত এই নির্দেশিকা খুবই কার্যকর বলে বিবেচিত। তবে শিশুর ‘খোরিয়া’ লক্ষণ দেখা গেলে কিংবা ‘দেরিতে হওয়া কার্ডাইটিস’ থাকলে বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্তপূরণের প্রয়োজন পড়ে না।
বাতজ্বরের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
► শিশুর বাতজ্বর হলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে আশু চিকিৎসা নেওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তিপূর্বক চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে চিকিৎসা চালাতে হবে।
► সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধক ওষুধ পেনিসিলিন গ্রহণের মাধ্যমে শিশুর বাতজ্বর ও বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রাথমিক প্রতিরোধ
স্ট্রেপটো গলা ব্যথার পাশাপাশি (উপসর্গ দেখা দেওয়ার ৯ দিনের মধ্যে) মাংসপেশিতে এক ডোজ বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন প্রদান। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পেনিসিলিন ট্যাবলেট একটানা ১০ দিন সেবন করতে হবে।
সেকেন্ডারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা
যারা এক বা একাধিকবার বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে অথবা বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে ভুগছে, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যবস্থায় প্রতি চার সপ্তাহ অন্তর একটা বেনজাথিন পেনিসিলিন (শিশুর ওজন ৬০ পাউন্ড বা তার কম হলে ছয় লাখ ইউনিটের ও ৬০ পাউন্ডের বেশি হলে ১২ লাখ ইউনিটের) ইঞ্জেকশন নিতে হবে। তা না করে বছরে দুই, চার, পাঁচটা ইঞ্জেকশন দিয়েও কোনো লাভ নেই।
► যে ছেলে, মেয়ে বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হয়নি, তার ২১ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বা কমপক্ষে পাঁচ বছর (যেটা সময়টা দীর্ঘ) ধরে এই প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
► শিশু যদি বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়, তখন প্রতি তিন সপ্তাহ অন্তর এই ব্যবস্থা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আরো দীর্ঘসময় ধরে, এমনকি সারা জীবন পর্যন্ত গ্রহণ করতে হতে পারে।
বাতজ্বরে খাদ্যপুষ্টি
বাতজ্বরের শিশুর জীবনযাপন পদ্ধতি এভাবে অনুসরণ করা, যেমন—
► প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো।
► নিয়মিত খেলাধুলা করা।
► বিশুদ্ধ বাতাস ও বিশুদ্ধ পরিবেশে সময় কাটানো।
► দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া।
► ঠাণ্ডা-সর্দি, দাঁত, মুখের সংক্রমণ বা যেকোনো ধরনের ইনফেকশন থেকে সতর্ক থাকা।
► প্রচুর পরিমাণ শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ, শস্য জাতীয় খাবার ইত্যাদি খাওয়া। চা, কফি এবং কোনো ধরনের টিনজাত খাবার ও বাইরের তৈরি খাবার খাওয়া উচিত নয়।
► রোগী রোগমুক্ত হবে এবং সুস্থ জীবনযাপন করবে—এই বিশ্বাস সব সময় মনে ধারণ।
অভিভাবকদের উদ্দেশে
► নির্দিষ্ট সময় বিরতিতে ডাক্তার দেখিয়ে শিশুর চেকআপ করা।
► ভালো হয়ে যাওয়ার পর আবারও শিশুর দুর্বলতা ফ্যাকাশে ভাব দেখা গেলে বা শিশুর বৃদ্ধি-বিকাশ ঠিকমতো না হলে অবিলম্বে শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
► শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা।
► যদি শিশুর জ্বর হয় বা গলা ব্যথা, গিঁটে ব্যথা দেখা দেয়, তবে অতিসত্বর শিশু চিকিৎসকের পরামর্শমতো উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক নিয়মিত সেবন করানো।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url