কে এই ওসমান বে, কেন আজও এত জনপ্রিয়–৩

 

দ্বিতীয় পর্বে আমরা জেনেছিলাম, কায়ি গোত্রের প্রধান বে হওয়ার পর থেকে ওসমান নিজের স্বপ্ন দেখা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় বেশ জোর দেওয়া শুরু করেন। সোগুতে নতুন বাজার চালু করেন, যেখানে তুর্কি ভিনদেশি ও রোমান বণিকদের জন্য দরজা খুলে দেন। কয়েকটি রোমান দুর্গের জমিদার ওসমানের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও কোনো কোনো রোমান জমিদার আবার ওসমানের সঙ্গে ব্যবসা করত না। বরং তুর্কি বে ওসমানের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে থাকায় কয়েকজন রোমান জমিদার হিংসা করে ওসমানের সঙ্গে শত্রুতাও করত। এমনই এক রোমান জমিদার ছিলেন আয়া নিকোলা। আয়া নিকোলার সঙ্গে ওসমানের বেশ শত্রুতা চলছিল ওসমান কায়ি গোত্রের প্রধান হওয়ার পর থেকেই। ১২৮৪ সালের দিকে এরমেনি পর্বতের কাছে ওসমান ও নিকোলার যুদ্ধ হয়। ওসমানের ২০০ সৈন্য নিকোলার ৪০০ সৈন্যের মুখোমুখি হয়।


ঐতিহাসিক সূত্রমতে, এরমেনি পর্বতের কাছে এ যুদ্ধে ওসমানের সৈন্যদের ফাঁদে ফেলে নিকোলা। ফলে প্রথম দিকেই ওসমানের সৈন্যরা চরম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে ওসমান ও তার সৈন্যরা রুখে দাঁড়ায় এবং সাহসিকতার সঙ্গে দ্বিগুণ শত্রুসেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে ওসমান ও নিকোলা উভয় পক্ষেরই সমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা দাবি করে থাকেন। তাই কে আসলে এ যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল, সেটা অমীমাংসিতই রয়ে যায়। এ যুদ্ধে ওসমানের ভাতিজা বায়হোচা মৃত্যুবরণ করে (ওসমানের মেজ ভাই সাভচির পুত্র বায়হোচা)। তা ছাড়া ওসমানের বেশ কিছু সৈন্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।

ওসমান পরবর্তী সময়ে ১২৮৫ সালের দিকে রোমান জমিদার আয়া নিকোলার কুলুচাহিসার দুর্গে আক্রমণ করেন। ওসমানের সঙ্গে ছিল তখন তিন শ সৈন্য, বিপরীতে নিকোলার দুর্গে এক হাজারের মতো সৈন্য ছিল। দুর্গের ভেতরে ওসমানের কায়ি সৈন্যদের সঙ্গে তিন গুণ শত্রু রোমান সৈন্যের তুমুল যুদ্ধ হয়। কিছু সময় পর বেশ সাহসিকতার সঙ্গে ওসমান এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন ও ওসমান কুলুচাহিসার দুর্গের মালিক হয়ে যান। নিকোলা পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে পালিয়ে যায়। নতুন এ দুর্গে কায়ি গোত্রের পতাকা উত্তোলন করে ওসমান তার বাবার জয় করা প্রথম দুর্গ কারাচাহিসারের পর দ্বিতীয় দুর্গ কুলুচাহিসারকে কায়ি গোত্রের অধীনে নিয়ে আসেন।

ওসমান কুলুচাহিসারের জনগণের ওপর পূর্বে রোমানদের আরোপিত অতিরিক্ত করের বোঝা কমিয়ে দেন। ওসমানের অধীনে এই দুর্গের তিন হাজারের মতো খ্রিষ্টান জনগণও বেশ শান্তিতে বসবাস শুরু করেন। ওসমানের এ বিজয়ের খবর সীমান্ত ছাপিয়ে সেলজুক রুম সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে ওসমানের সাহসিকতার বেশ প্রশংসা চলতে থাকে। কুলুচাহিসার দুর্গ হাতছাড়া হওয়াতে তৎকালীন রোমান সম্রাট ক্ষুব্ধ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে রোমান সৈন্যবাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১২৮৭ সালের দিকে ডোমানিক অঞ্চলের কাছে রোমান সীমান্ত ভূমিতে ওসমান ও রোমান সাম্রাজ্যের কমান্ডার প্লাটিয়স মুখোমুখি হয় নিজেদের সৈন্য নিয়ে। তুলনামূলকভাবে কম সৈন্য থাকলেও ওসমান এ যুদ্ধে বেশ সাহসিকতার সঙ্গে জয়লাভ করেন। এ যুদ্ধে ওসমানের মেজ ভাই সাভচি বে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে রোমান কমান্ডার প্লাটিয়সও এ যুদ্ধে নিহত হন। ডোমানিকের যুদ্ধে ওসমান জয়লাভ করলেও ভাইয়ের মৃত্যুতে তিনি বেশ মর্মাহত হন এবং সাভচি বের বেঁচে থাকা একমাত্র পুত্র সন্তান সুলেইমানকে নিজে লালন–পালন শুরু করেন। কিছু সূত্র অনুযায়ী, আয়া নিকোলা পুনরায় ফিরে এসে ওসমানের বাবা আরতুগ্রুলের জয় করা কারাচাহিসার দুর্গে হামলা চালান এবং তা দখল করে নেন। ওসমানও দেরি না করে কারাচাহিসার দুর্গ অবরোধ করেন। ১২৮৮ সালে ওসমান নিজের সৈন্যদের নিয়ে কারাচাহিসার দুর্গে অভিযান চালিয়ে তা পুনর্দখল করেন। নিকোলা আবার পালিয়ে যায়। ওসমানের বিজয়ের খবর আবারও বেশ জোরালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।


এভাবে ওসমান কয়েক বছর মঙ্গলদের ঝামেলা ছাড়াই রোমান দুর্গ জয় করতে পারলেও হঠাৎ বিপত্তি বাধে। তৎকালীন সেলজুক রুমের সুলতান মাসুদ মঙ্গলদের যেসব তুর্কি গোত্র কর দিতোনা, সেই গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে থাকেন। আর এ অভিযানে তাকে দু-তিন হাজার মঙ্গল সৈন্য দিয়ে সহায়তা করতেন তৎকালীন আনাতোলিয়ার মঙ্গল গভর্নর গেয়হাতু। গেয়হাতু ছিলেন তৎকালীন ইলখানাত সাম্রাজ্যের মঙ্গল সম্রাট আরগুন খানের ছোট ভাই। গেয়হাতুর এ জন্য বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল আনাতোলিয়াতে। তা ছাড়া গেয়হাতুর সঙ্গে কর না দেওয়া তুর্কি গোত্রগুলোর বিরোধ লেগেই থাকত এবং খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকত। মূলত গেয়হাতু ও মঙ্গল সম্রাটের জোর দেওয়ার কারণেই সুলতান মাসুদ এ অভিযান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই সময়ে ওসমানের কায়ি গোত্রের মতো আরও কয়েকটি তুর্কি গোত্র মঙ্গলদের কর দিত না বিধায় সেই গোত্রগুলোর কেউ কেউ এক হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। ফলে কারামানিদ, জার্মিয়ান ও এশরেফিদ নামক তিনটি স্বাধীন তুর্কি বেইলিকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ওসমান এসবে সায় না দিয়ে আপাতত সেলজুক রুমের আনুগত্য করতে থাকেন কারণ, তিনি সেলজুক ও মঙ্গল উভয়ের সঙ্গে ঝামেলায় না গিয়ে তার সীমান্ত ভূমিতে রোমান শত্রুদের ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন। আনাতোলিয়ায় জার্মিয়ান, কারামানিদ ও এশরেফিদ—এ তিনটি স্বাধীনতা ঘোষণা করা তুর্কি বেইলিকের অঞ্চলে সুলতান মাসুদ মঙ্গলদের সহায়তায় আগ্রাসন চালান। এ যুদ্ধ কিছু সময়ের জন্য দীর্ঘায়িত হয়েছিল। (তুর্কি ভাষায় বেইলিক অর্থ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র।)

(*একটি বিষয় উল্লেখ করি, ‘কুরুলুস ওসমান’ সিরিজে মঙ্গল গভর্নর গেয়হাতু ও সুলতান মাসুদ উভয়কে বেশ বয়স্ক দেখানো হলেও ঐতিহাসিকভাবে বাস্তবে তারা দুজনই ওসমানের চেয়ে বয়সে পাঁচ-ছয় বছরের ছোট ছিলেন।)

(*আর একটি কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ওসমান যেমন অতি সাহসী ছিলেন, তেমনি ন্যায়ের প্রতি তিনি ছিলেন অটল। তাই অন্যায়কে অন্যায় মনে করা এবং সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহসিকতা রাখা হলো বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের আইডল ওসমানেরও আদর্শ।) চলবে...

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url