সূর্যের আলোয় বন্যার পানি জীবাণুমুক্ত করার সহজ উপায়
বন্যায় পান করার জন্য নিরাপদ পানি প্রধান এক সমস্যা। অথচ বন্যার পানিকেই আমরা পানের উপযোগী করে নিতে পারি, যদি এর মধ্যে থাকা ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা ইত্যাদির রোগজীবাণুকে মেরে ফেলতে পারি। এ জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি জানা থাকলেও হাতের কাছে যেটি পাওয়া যায়, সেটিই আমরা ব্যবহার করতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান ও পরবর্তী সময় বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে বহু বছরের গবেষণায় সফল একটি সহজ সৌর পানি পাস্তুরাইজেশন যন্ত্র তৈরি হয়েছে। এই যন্ত্র সম্পর্কে বিশদ তথ্য এখানে তুলে ধরব। এই যন্ত্র নিজেরাই বানিয়ে নিতে পারবেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমের নেতৃত্বে বিভিন্ন পরীক্ষায় পানিবাহিত জীবাণুনাশে এর সফলতা প্রমাণিত হয়েছে।
‘পাস্তুরাইজেশন’ (পাস্তুরায়ণ বা পাস্তুরীকরণ) পদ্ধতি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের আবিষ্কার। দুধকে পানের উপযোগী করে জীবাণুমুক্ত করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। দুধ বা পানিকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আধা ঘণ্টা বা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে মাত্র ১৫ সেকেন্ড রাখলে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের জীবাণু মরে যায়। প্রচলিত ধারণায় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফোটানোর প্রয়োজন হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৌর পাস্তুরাইজারে বিখ্যাত গ্রিনহাউস ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়। এর ফলে গ্রীষ্মকালে ৯০ ডিগ্রির ওপরেও তাপমাত্রা পাওয়া গেছে আর শীতকালে ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি পাওয়া গেছে। আমাদের তৈরি সৌর পাস্তুরাইজারে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিও পানিতে প্রবেশ করে। তাই ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও জীবাণু ভালোভাবে ধ্বংস হয়েছে দেখা গেছে। সৌর পাস্তুরাইজারে পানিবাহিত রোটা ভাইরাস ও হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসও ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিষ্ক্রিয় হয়। তাই এ পাস্তুরাইজার পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। বন্যা ছাড়াও সাধারণ সময় আমরা এ যন্ত্র ব্যবহার করতে পারব। আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলে টিউবওয়েলের পানি পান করার অযোগ্য। তবে নদী, খাল বা পুকুরের পানিতে আর্সেনিক নেই, আছে কেবল রোগজীবাণু। সেই পানিকে এ পাস্তুরাইজার দিয়ে পানের জন্য নিরাপদ করে নেওয়া যাবে।
কীভাবে বানাতে হবে পাস্তুরাইজার
সৌর পাস্তুরাইজারের জন্য এক ইঞ্চি পুরু কর্কশিট থেকে তৈরি একটি ট্রে ব্যবহার করতে হবে (প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে)। এর কিনারাগুলো যেন এক ইঞ্চি উঁচু হয়। এর জন্য কিনারার কর্কশিটের টুকরাগুলো নারকেলের শলা ঢুকিয়ে পাটাতনের সঙ্গে আটকে দিতে হবে। শলাগুলো সোজা না ঢুকিয়ে একটু কোণে এদিক–সেদিক করে লাগালে শক্তি বেশি হবে। চাইলে সাদা কাঠের আঠাও মাঝখানে দেওয়া যায় বাড়তি শক্তির জন্য। মাঝখানে একটি ঘন কালো কাপড় বিছানো থাকবে। এটিই সূর্যের আলো শোষণ করে তাপশক্তি তৈরি করে। বন্যার পানিকে কয়েক ভাঁজ করা পুরোনো কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে যেন তা স্বচ্ছ হয়। ট্রের আকারের থেকে সামান্য বড় একটি স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগে পানি ভরে নিতে হবে। পানির পরিমাণ এতটা হবে যেন ব্যাগটি ট্রেতে বিছিয়ে দিলে পানির গভীরতা আধা ইঞ্চির বেশি না হয়। ব্যাগের খোলা মুখটি ট্রের পাটাতনের যে দিকে বাড়তি আছে, সে দিকে রাখতে হবে যেন তা এ দিকের উঁচু ধারের ওপর দিয়ে চলে যায়। এবার বিছিয়ে থাকা ব্যাগে পানির ওপরে যে বাতাসের কিছু বুদ্বুদ্ দেখা যাবে, সেগুলোকে হাতের আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় ব্যাগের মুখের দিকে নিয়ে বের করে দিতে হবে। ভেতরে কোনো বুদ্বুদ্ যেন না থাকে।
এবার ট্রের মাপে আর একটি স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগের মধ্যে ছবির মতো একটি চার কোনা শক্ত ফ্রেম ঢুকিয়ে দিতে হবে যেন ব্যাগটি টানটান থাকে এবং ভেতরে আবদ্ধ বাতাসের একটি স্তর তৈরি হয়। খোলা মুখটি তাপ দিয়ে সিল করে দিতে হবে অথবা স্বচ্ছ টেপ দিয়ে আটকাতে হবে। ফ্রেমটির উচ্চতা আধা ইঞ্চির মতো হলে ভালো হয়। ফ্রেম তৈরির জন্য বাঁশ, কাঠ, অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের সরু নল বা রড ব্যবহার করা যায়। বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের লাইন টানার জন্য যে প্লাস্টিকের চ্যানেল ব্যবহার করা হয়, সেটি দিয়ে আমাদের ফ্রেমটি তৈরি করা হয়েছে। একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে চার কোনা গরম করে বাঁকা করে নেওয়া হয়েছে ও জোড়াটিকে স্কচটেপ বা অন্য ভালো আঠাযুক্ত টেপ দিয়ে আটকানো হয়েছে। এ ব্যাগে বদ্ধ বাতাসসহ ফ্রেমটি ট্রের উঁচু কিনারার ওপর রেখে শেষ ছবির মতো দুটি সরু রশি দিয়ে নিচের পাটাতনের সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। ব্যস, হয়ে গেল আমাদের সৌর পাস্তুরাইজার। একে পরিষ্কার রোদে সমান কোনো স্থানে রেখে দিতে হবে। দুই ঘণ্টা পর এসে ওপরের ফ্রেমটি সরিয়ে পানি ভরা ব্যাগের ওপর হাতের আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে দেখতে হবে যথেষ্ট গরম হয়েছে কি না। যদি দু–এক সেকেন্ডের বেশি স্পর্শ করে রাখা না যায়, তাহলে বুঝতে হবে যথেষ্ট গরম হয়েছে। না হলে আরও কিছুক্ষণ রোদে রাখতে হবে।
কীভাবে কাজ করে
সৌর পাস্তুরাইজারে সূর্যের আলো স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগ ও স্বচ্ছ পানির স্তর ভেদ করে নিচের কালো কাপড়ে শোষিত হয়। ফলে সেখানে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা ওপরে লেগে থাকা ব্যাগের পানিতে পরিবাহিত হয়ে পানি গরম হয়। কিন্তু নিচে ও পাশে কর্কশিট এবং ওপরে আবদ্ধ বাতাসের স্তর তাপকে বেরোতে দেয় না। ফলে ব্যাগের পানি অনেক উত্তপ্ত হয়ে যায়। খেয়াল করা যেতে পারে যে পলিথিন ব্যাগে পানির উচ্চতা প্রায় আধা ইঞ্চি, আর ট্রের চারদিকের কিনারাগুলোর উচ্চতা এক ইঞ্চি। তাই এখানেও আধা ইঞ্চি উচ্চতার একটি আবদ্ধ বাতাসের স্তর পাওয়া যাবে। তাই ওপরে ঢাকনা হিসেবে ফ্রেমে আটকানো পলিথিন ব্যাগসহ মোট দুটি স্তরে আবদ্ধ বাতাসের স্তর পাওয়া যাবে, যা আমাদের পাস্তুরাইজারে উচ্চ তাপমাত্রা পেতে সাহায্য করছে।
কীভাবে ব্যবহার করব
বন্যার পানি সাধারণত ঘোলা হয়ে থাকে। তবে পানিকে এ প্রক্রিয়ায় উত্তপ্ত করতে হলে তা স্বচ্ছ হতে হবে, ঘোলা হলে চলবে না। তাই বন্যার পানিকে কয়েক ভাঁজ পুরোনো কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে অথবা ফিটকিরি ব্যবহার করে ময়লা থিতিয়ে নিয়ে ওপরের পরিষ্কার পানি ব্যবহার করতে হবে। পুরোনো কাপড়ের কথা কেন বলা হয়? বারবার ধোয়ার ফলে কাপড়ের সুতা থেকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আঁশ বেরিয়ে প্রতিটি সুতার চারদিকে ছড়িয়ে থাকে। এ আঁশগুলো সূক্ষ্ম ধূলিকণা আটকাতে পারে। নতুন কাপড়ে এ সূক্ষ্ম আঁশগুলো থাকে না।
যন্ত্রটিকে পরিষ্কার রোদে সমতলে রাখতে হবে, যেন কোনো দিকে কাত না হয়ে থাকে। বন্যায় সমতল মাটি পাওয়া না গেলে যন্ত্রটিকে পানিতেই ভাসিয়ে রাখা যায়। কর্কশিট হালকা, তাই এটি পানিতে ভাসবে। ভেসে যেন দূরে চলে না যায়, সে জন্য যন্ত্রটিকে একটি রশি দিয়ে কোনো একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখি। এ ক্ষেত্রে জীবাণুযুক্ত বন্যার পানি যেন আমাদের পাস্তুরাইজারের পানির ব্যাগের মুখে লেগে না যায়, সে জন্য ট্রের পাটাতনটি একদিকে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পলিথিন ব্যাগের খোলা মুখটি যেন পাটাতনের বাইরে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখব। প্রয়োজনে খোলা মুখটি একটু মুড়িয়ে দেব।
পানি যথেষ্ট গরম হয়ে গেলে ওপরের ফ্রেমটি সরিয়ে সাবধানে ব্যাগের মুখটি চেপে ধরে আস্তে আস্তে পানি ভরা ব্যাগটি উঠিয়ে ঠান্ডা করার জন্য কোনো কলসি বা জগে ঢেলে নিই। ব্যাগটিতে আবার পানি ভরে একইভাবে আবারও পাস্তুরাইজ করার জন্য যন্ত্রটি রোদে রেখে দিই। এক দিনে দু-তিনবার এভাবে পানি পাস্তুরিত করা সম্ভব। শীতকালে রোদে আঁচ কম থাকায় একটু বেশি সময় লাগতে পারে। বন্যার সময় ঘরে কলসি বা জগ না থাকলে পানি ভরা পলিথিন ব্যাগের মুখ পেঁচিয়ে বন্ধ করে রেখে দিতে হবে। তাতে আরও বাড়তি সুবিধা হলো যে হাতে কলসি বা জগে অনেক সময় জীবাণু লেগে থাকতে পারে, এ ক্ষেত্রে সে আশঙ্কা থাকবে না। তাই পানি এক মাস বা তারও বেশি সংরক্ষণ করা যাবে। এ রকম কয়েকটি পলিথিন ব্যাগে পানি গরম করে সংগ্রহ করা যায়।
ছবিতে দেখানো যন্ত্রটির আকার প্রায় ২০ x ১৮ ইঞ্চি। মূলত ওপরের ফ্রেমটি যেন বাজারে পাওয়া পলিথিন ব্যাগের আকারে হয়, সে জন্য এ মাপ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বন্যায় স্বেচ্ছাসেবীরা সহজে অনেক যন্ত্র একসঙ্গে বেঁধে নিয়ে যেতে পারবেন। এ মাপের যন্ত্রে একবারে প্রায় তিন লিটার পানি পাস্তুরিত করা যাবে। চাইলে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে এর থেকেও বড় পলিথিন ব্যাগের মাপে আরও বড় পাস্তুরাইজার বানানো যাবে।
বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইব্রাহিম সিএমইএস নামে তাঁর একটি সংগঠনের মাধ্যমে বরিশালের কয়েকজন বেঁদে সর্দারকে ঢাকায় এনে এই প্রযুক্তির ওপর সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। পরে জানা যায় সেখানকার প্রায় ৩০০ বেঁদে পরিবার এ প্রযুক্তি প্রায় ৩ বছর ধরে ব্যবহার করছিল। পরে তারা নিজেরাই যন্ত্র বানিয়ে নিতে পেরেছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের টিউবওয়েল স্থাপন করে দিলে তারা এ যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। কয়েক বছর আগে ঢাকার রায়েরবাজার বস্তিতে ১৫টি পরিবারকে এ যন্ত্র বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে বিভিন্ন সময় গিয়ে দেখা যায়, তারা নিয়মিত এ যন্ত্র ব্যবহার করছে। গবেষণায় দেখা যায়, তাদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপও অনেক কমে গেছে।
দেশের উদ্ভাবন মানুষের কল্যাণে এলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন যথাযথভাবে ব্যবহার করে আমাদের জীবন নিরাপদ ও উন্নত হোক।
খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক। ই–মেইল: mdkaosar154@gmail.com
মো. আবু ইউসুফ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিমেডিসিন প্রোগ্রামের সমন্বয়ক
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url